বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:এবার শিশির অধিকারিকে নিয়ে তোলপাড় পশ্চিমবাংলার রাজনীতি। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি কাঁথির তৃণমূল সাংসদ শিশির অধিকারি সত্যিই বিজেপিতে যোগ দিতে চলেছেন? কারণ, ভোটের মুখে তাঁর নজিরবিহীন আক্রমণাত্মক মন্তব্য। আর তাতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে বাংলার রাজনৈতিক মহলে। দলের দিকে এক প্রকার আঙুল তুলে দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ছেলে শুভেন্দু তো বটেই, তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধেও নোংরা আক্রমণ করা হচ্ছে। আর তা করা হচ্ছে দলের তরফেই। পরিস্থিতি এমন দিকে পৌঁছে গিয়েছে যে, এবার তা প্রতিহত করতে তাঁকেই উদ্যোগী হতে হচ্ছে।
একটি বাংলা সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শিশিরবাবু বলেছেন, ‘আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছি, এখন আমার গোটা পরিবারকে লক্ষ্য করে সরাসরি আক্রমণ করা হচ্ছে। এই আক্রমণ থেকে আমার ছেলেও বাদ নেই। এমন আক্রমণ যদি চলতে থাকে, তা হলে তো তা আমায় প্রতিহত করতেই হবে।’ তাঁর সরাসরি চাঁছাছোলা বক্তব্য, ‘এতদিন ধরে রাজনীতি করছি। কিন্তু এখন যে রাজনৈতিক আক্রমণ আমার পরিবারের বিরুদ্ধে চলছে, তা একেবারেই অবর্ণনীয়। জীবনে আমার শত্রুপক্ষও কোনও দিন এ ভাবে আমার বা আমার পরিবারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে আক্রমণ করে যেতে পারেনি। এমনকী, সিপিএম, কংগ্রেসের কেউও আমার বা আমাদের বিরুদ্ধে এমন নোংরা বা আপত্তিজনক কথা বলতে পারেননি।’
বলা বাহুল্য, তাঁর বক্তব্যের নিশানা যে তাঁর নিজেরই দল তৃণমূল, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। এর পরই সরাসরি তিনি নিজের দলের কথাই বলেন। অভিযোগ করেন, ‘কিছু নিকৃষ্ট মানের লোকজনকে আমাদের দল এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তারা প্রতিনিয়ত আমার পরিবারের বিরুদ্ধে জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করে যাচ্ছেন। যাঁরা নিজেদের উপরতলার নেতা হিসেবে মনে করেন, তাঁরাও চুপ করে নেই। তাঁরা হামেশাই আমার পরিবারের বিরুদ্ধে আক্রমণ করছেন। সেই আক্রমণ আমায় প্রতিহত করতে হবে। এ ছাড়া আর উপায় দেখছি না।’ উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারি মাসে কাঁথিতে গিয়ে জনসভা করেছেন তৃণমূল সাংসদ তথা মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। গিয়েছিলেন না কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়ও। তাঁরা প্রত্যেকেই নিশানা করেন শুভেন্দু অধিকারি–সহ গোটা পরিবারকেই।
শিশিরবাবু অভিযোগ করেছেন, ‘তাঁরা রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য শুনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, তাঁরা রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করতে এখানে আসেননি। তাঁদের এখানে আসার মূল লক্ষ্যই ছিল আমার পরিবারের বিরুদ্ধে আপত্তিজনক ভাষায় আক্রমণ করে যাওয়া। তাই শুধু রাজনৈতিক আক্রমণ করেই তাঁরা থেমে যাননি। অকথ্য ভাষাও ব্যবহার করে গিয়েছেন।’ এর পর তিনি সরাসরি ছেলে শুভেন্দু অধিকারির নাম করে বলেন, ‘শুভেন্দুকে কী ভাষায় তাঁরা আক্রমণ করে চলেছেন, তা আপনারা সকলেই জানেন। তাঁর ওপর ১১ বার নন্দীগ্রামে আক্রমণ হয়েছে। দলের ভিতরে থাকাকালীন ফালতু সারদা–নারদায় তাঁকে জড়নো হয়েছে। পুরোপুরি মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে আমার ছেলের বিরুদ্ধে।’
শিশির অধিকারির এই মন্তব্যে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক মহলে। তাদের মতে, এর পর শিশির অধিকারি যে কোনও সময় তৃণমূল ত্যাগ করতেই পারেন। সেইজন্যই হয়তো তিনি এমন সাহসী মন্তব্য করেছেন। তিনি জানেন, তাঁর এই মন্তব্য দলনেত্রী ভালো ভাবে নেবেন না। তবু তিনি এমন মন্তব্য করতে পিছপা হননি। এর অর্থ পরিষ্কার। অবশ্য তৃণমূল ছেড়ে যাবেন কিনা, তা নিয়ে শিশির অধিকারি সরাসরি কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি। এ বিষয়ে রাজনৈতিক ভাবে জানিয়েছেন, তিনি দলে আছেন কিনা, তা বলতে পারবেন দলের শীর্ষনেতারাই। এখন তো কিছু নেতা যেন সবার উপরে পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁরাই ঠিক করে ফেলছেন, কে দলে আছে, আর কে নেই!
অবশ্য তাঁর একটি মন্তব্য জল্পনা উস্কে দিতে পারে বলে মনে করছে তথ্যাভিজ্ঞ মহল। তিনি বলেছেন, ‘মাঠে তো বিজেপি আছেই। তাই গেরুয়া শিবিরই এগিয়ে আছে।’ যদিও এই বক্তব্যের অর্থ পরিষ্কার করেননি তিনি। তবে তাঁকে দলে পেলে সাদরে বরণ করে নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে বিজেপি। দলের নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার বলেছেন, ‘তিনি প্রবীণ নেতা। সম্মান পেতে হলে, মানুষের পাশে দাঁড়াতে হলে, দেশের জন্য কিছু করতে হলে বিজেপি ছাড়া আর কোনও দল আছে কি? গোটা দেশে এখন তো একটা জাতীয় দল, আর সেখানেই সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায়।’
চুপ করে নেই তৃণমূলও। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ পাল্টা আক্রমণ করে বলেছেন, ‘তৃণমূলের যুবনেতা এবং তাঁর পরিবারের প্রতি লাগাতার ব্যক্তিগত আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন শিশিরবাবুর ছেলে শুভেন্দু অধিকারি। তার পরেও কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোনও উচ্চাবাচ্য করেননি শিশিরবাবু। প্রতিবাদও করেননি। অন্যদিকে, তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তাঁকে শ্রদ্ধাই করেন। তা হলে যুক্তিতে শিশিরবাবুর তত্ত্ব দাঁড়াচ্ছে কি? তাঁর মন যদি অন্য কোথাও থাকে, তা হলে সেই সিদ্ধান্ত তিনি নিতেই পারেন।’ কুণালের এই মন্তব্যে কিন্তু প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, তৃণমূলও কি ধরে নিয়েছে যে, শিশির অধিকারিও বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন? শুধু কুণাল ঘোষই নন, তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও এদিন বলেছেন, ‘শিশিরদা প্রবীণ মানুষ। তাই তাঁর সম্পর্কে বেশি কিছু বলতে চাই না। তবে সবাই বুঝতে পারছেন, তাঁর হৃদয় কোথায় রয়েছে, আর কোথায়ই বা রয়েছে তাঁর শরীর! আগে শিশিরদাই বরং সেটা ঠিক করে নিন। তিনি তো দু’পা বাড়িয়েই রয়েছেন। তাঁর বক্তব্যেই সেটা প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে।’
এদিকে, এদিন শুভেন্দু অধিকারিকে নজিরবিহীন ভাবে আক্রমণ করলেন তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর। তিনি বলেছেন, ‘শুভেন্দু অধিকারি কত বড় নেতা, সেটা বোঝা যাবে ২ মে–র পর।’ কিন্তু একটি দলের পরামর্শদাতা হিসেবে তিনি এ ভাবে কোনও নেতার সমালোচনা করতে পারেন কিনা, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। যদিও এ ব্যাপারে এদিন রাত পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি শুভেন্দু। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি ব্যস্ত রয়েছেন। রাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ডাকে তিনি দিল্লি রওনা হয়ে গিয়েছেন। মনে করা হচ্ছে, বিজেপির প্রার্থী তালিকা তৈরির ব্যাপারে পরামর্শ করতেই অমিত শাহ তাঁকে দিল্লি ডেকে পাঠিয়েছেন। তাঁর পাশাপাশি দিল্লি গিয়েছেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়, মুকুল রায়, দিলীপ ঘোষ প্রমুখ নেতারা।
তবে, বুধবার পিংলায় বিজেপির এক জনসভায় শুভেন্দু অধিকারি তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘নন্দীগ্রামে আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাব। এ ব্যাপারে একশো শতাংশ নিশ্চিত থাকবেন আপনারা। আমি তাঁকে হারাবই। দল যদি আমাকে সেখানে প্রার্থী করে, তা হলে আমিই সরাসরি তাঁকে হারাব। আর, যদি অন্য কাউকে প্রার্থী করে, তা হলে নন্দীগ্রাম থেকে জিতিয়ে আনব। নিশ্চিত থাকুন, নন্দীগ্রামে আমি পদ্ম ফোটাবই। দায়িত্বটা আমিই নিয়েছি।’
এদিকে, তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন দুই প্রাক্তন আমলা। হিডকোর চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন এবং রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা তৃণমূলে যোগ দেবেন বলে ওই দলের সূত্রে জানা গিয়েছে। সূত্রের আরও খবর, ওই দু’জনকে প্রার্থীও করতে পারেন মমতা। দলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর নাকি মমতাকে এই পরামর্শই দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক আগাগোড়াই মধুর। তাই তাঁদের দলের প্রার্থী করার ব্যাপারে আপত্তি নেই তাঁরও।